[রিভিউ] আয়নাবাজি - হাস্যরসের আড়ালে মানুষের জীবনের গল্প
অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হলে (যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমা'স, বাসা থেকে কাছে) গিয়ে দেখে এলাম বহুল আলোচিত সিনেমা আয়নাবাজি। বিজ্ঞাপন নির্মাতা অমিতাভ রেজার প্রথম চলচ্চিত্র প্রয়াস হলেও মানুষের আগ্রহ এবং পজেটিভ রিভিউ দেখে সিনেমাটা দেখার আগ্রহ জন্মেছিল, যেটা আজ সার্থক হলো। সাথে কাউকে না পাওয়ায় বরাবরের মত একাই গিয়ে দেখে এলাম। ব্যক্তিগতভাবে অপরিচিত মানুষদের মধ্যে একা বসে সিনেমা দেখতে মন্দ লাগেনি। আড়াই ঘন্টা দ্রুতই কেটে গেলো মনে হয়েছে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান গতিতে কাহিনী এগুনোয় বিরক্তি লাগেনি বসে থাকতে। পপকর্ন আর টিকেটের টাকা উসুলই বলা চলে! যাই হোক, এবার মূল রিভিউ আলোচনায় আসা যাক। শুরুতে বলতে চাই আয়নাবাজি চলচ্চিত্রের পটভূমি (বা কাহিনী) সম্পর্কে। ভয় নেই, স্পয়েলার দিবোনা। এই চলচ্চিত্র অনেকেই এখনো দেখেননি। স্পয়েলার দিয়ে এদের আগ্রহে পানি ঢেলে দিতে চাইনা। অতএব, নিশ্চিন্তে বাকিটুকু পড়ে ফেলতে পারেন।
কাহিনী সংক্ষেপ
চঞ্চল চৌধুরী মানে আয়না (পুরো নাম শরাফত করিম আয়না) একজন অভিনয়প্রেমী মানুষ। পারিবারিক ভাবেই অভিনয় রক্তে মিশে আছে তার। পুরানো ঢাকার এক মহল্লার বাচ্চাদের নাটক স্কুলে অভিনয় শিখিয়ে দিন কাটে। কিন্তু এটা তার বাইরের মুখোশ। ভিতরে সে একজন পেশাদার প্রক্সিবাজ, মানে মূল অপরাধীদের পক্ষ হয়ে সে ছদ্মবেশে জেল খাটে। মূল অপরাধীরা রয়ে যায় বাইরে। কিছুদিন পর অপরাধী খালাস পেয়ে মুক্ত হয়, আয়না জেল থেকে বেরিয়ে এসে মিশে যায় তার চেনা পরিবেশে। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো। কিন্তু ঘটনাচক্রে এক পত্রিকার ক্রাইম রিপোর্টারের (পার্থ বড়ুয়া) টার্গেটে পরিণত হয় সে। আর এরমধ্যেই আয়নার জীবনে প্রেম আসে তার প্রতিবেশী হৃদির (নাবিলা) রুপ ধরে। আয়না হৃদির মধ্যে খুঁজে পায় নিজের ভবিষ্যত, নিজের জীবনের দুঃখ ভোলার সাথী। সে ছেড়ে আসতে চায় অপরাধের পথ। কিন্তু বাস্তবতা হয় ভিন্ন, তাই এক রাজনৈতিক নেতা তাকে বাধ্য করে আবারো অপরাধের পেশায় ফিরে আসতে। সেই খুনী নেতার পক্ষ হয়ে জেলে যায় আয়না। কিন্তু এবার আর খালাস মেলেনা তার, রায় হয় ফাঁসির। নির্দোষ আয়না ফেঁসে যায় জালে। সে কি পারবে ফাঁসি এড়াতে? কি হবে তার সাথে হৃদির সম্পর্কের ভবিষ্যত? মূল অপরাধী ঐ নেতা কি আইনের হাত থেকে রেহাই পাবে? ক্রাইম রিপোর্টার কি প্রমাণ করতে পারবে আয়না মূল অপরাধী নয়? সবকিছু জানতে হলে আপনাকে দেখতে হবে সিনেমাটি। এটি শেষ পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষায় রাখবে চূড়ান্ত পরিণতির।
সিনেমাটির মূল যে আকর্ষণে হলে যাওয়া, মানে ক্যামেরা ওয়ার্ক এবং স্টোরিলাইন- দুটোই মোটামুটি মুগ্ধ করেছে। রাশেদ জামানের সিনেমাটোগ্রাফি আর পরিচালক অমিতাভ রেজার ক্যামেরার কাজ, অসাধারন মেলবন্ধন। ড্রোন ক্যামেরার এমন ব্যবহার বাংলা সিনেমায় সচরাচর দেখা যায়না। চেনাজানা ঢাকা শহর, এর রাস্তা, ব্রিজ, নদী, খাল সবকিছু পর্দায় সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে এই সিনেমাটি। পুরানো ঢাকার ঘিঞ্জি গলিগুলোও মনে হচ্ছিল কত চমৎকার। বৃষ্টির দৃশ্যগুলো ডিটেইলস এবং বাস্তবসম্মত। প্রথাগত ঢালিউডি কৃত্রিম বৃষ্টির দৃশ্য নয়। ওয়াইড এঙ্গেল শটে বুড়িগঙ্গা নদীর বিকেলের দৃশ্যাবলি, লঞ্চের আসা-যাওয়া আর পুরানো ঢাকার স্পটগুলো পরিচালকের মুন্সীয়ানার পরিচায়ক। ক্ষয়িষ্ণু বুড়িগঙ্গার এমন রুপ আগে দেখিনি, বুড়িগঙ্গায় ফটোওয়াকের আগ্রহ বাড়িয়ে দিলো এই সিনেমাটি। অমিতাভ রেজা বরাবরের মতই চমৎকার ক্যামেরার কাজ দেখিয়েছেন। উনার বিজ্ঞাপনে যে মান বজায় রাখেন তা রাখতে পেরেছেন এই সিনেমাতেও। হলের সাউন্ড কোয়ালিটি ভালো থাকায় প্রতিটি সংলাপ, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, সাউন্ড ইফেক্ট সবকিছুই পরিষ্কার শোনা গিয়েছে। সিনেমার স্টোরিলাইন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমান গতিতে এগিয়েছে তা আগেই বলেছি। বেশিরভাগ চরিত্র স্টোরিলাইন অনুযায়ী অভিনয় করেছে। ন্যাচারাল একটিং আর ডায়ালগ ডেলিভারির দিক থেকে চঞ্চল চৌধুরী আর নাবিলা পূর্ন নাম্বার পাবে। নাবিলার প্রথম সিনেমা হলেও সংলাপ আর অভিনয়ে সেটা মনে হয়নি। পার্থ বড়ুয়ার মদ্যপ ডিভোর্সি সাংবাদিক চরিত্রটি অনাবশ্যক লেগেছে আমার কাছে। ডিভোর্সি মানেই ঘন ঘন মদ্যপানে অভ্যস্ত ব্যক্তি- এই পুরানো স্টেরিওটাইপ থেকে বেরুতে পারেনি এই সিনেমাটাও। কাহিনীর হলিউড স্টুডিও এর পিচ্চিটা, নাবিলার বাড়ির চাকর মোসাদ্দেক কিংবা সাংবাদিকের বাড়ির চাকর চরিত্রটি অনেকটি কমিক রিলিফ হিসাবেই সিনেমায় এসেছে, কিন্তু এদের কমেডি হাসাতে পারেনি আমাকে। বরং চঞ্চল চৌধুরীর স্যাটায়ারধর্মী ডায়ালগ আর প্রয়োজন বুঝে কমেডি অভিনয় অধিক বিনোদন দিয়েছে। চঞ্চল চৌধুরী এমনিতেই কমেডিধর্মী চরিত্রে দক্ষ অভিনেতা, সেটা আরেকবার প্রমাণিত হলো। পুরো সিনেমাতে শুধু তার অভিনয়তেই হেসেছি, আনন্দ পেয়েছি। এই সিনেমাতে চঞ্চল চৌধুরীর আরেকটি চমক রয়েছে, যেটি এখানে বলতে চাইছিনা। পার্শ্ব চরিত্রে সিনেমার শুরুতে দেখানো লম্পট ব্যবসায়ী লুতফর রহমান জর্জের কিছু ডায়ালগ যৌনইঙ্গিতবাহী হলেও অনেকটা খাপছাড়া লেগেছে কাহিনীর সাথে। জর্জ ভালো অভিনেতা, কিন্তু লম্পট stalker চরিত্রে তাকে একেবারেই মানানসই লাগেনি। অতিথি চরিত্রে হালের জনপ্রিয় নায়ক আরেফিন শুভ আছেন চমক হিসাবে। পুলিশি ড্রেসে একজন নীতিবান অফিসার (এই অফিসার কিন্তু বিসিএস পাশ, সেকেন্ড হয়েছিলেন বিসিএসে, এই ব্যাপারটা মজা দিয়েছে) চরিত্রে শুভ তার আসন্ন 'ঢাকা এটাক' সিনেমাটির আভাস দিয়েছেন। ক্লাইম্যাক্সে আরেক চমক দিতে হাজির স্বয়ং পরিচালক, অমিতাভ রেজা নিজেই। তিনি কোন চরিত্রে আছেন সেটা আপনাকে হলে গিয়েই বুঝতে হবে। সিনেমার কাহিনীকার গাউসুল আজম শাওনও আছেন সিনেমায় একটি বিশেষ চরিত্রে।
অনলাইন রিভিউতে অনেকে সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার, পলিটিক্যাল ড্রামা, সাসপেন্স থ্রিলার ইত্যাদি ক্যাটেগরিতে এই সিনেমাটিকে ভূষিত করলেও আমার কাছে কাহিনী অনুযায়ী এটিকে কমেডি ড্রামাই (থ্রিলার ক্যাটেগরিতে ফেলবোনা এটাকে) মনে হয়েছে। কাহিনীতে হাস্যরসের আধিক্য সেটা বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু হাস্যরসের আড়ালে আয়নার জীবনের কষ্ট, স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতি আর আয়নার জন্য ধীরে ধীরে জন্ম নেওয়া হৃদির ভালোবাসা- এগুলোই সিনেমাটির কাহিনীতে গতি সঞ্চারে ভূমিকা রেখেছে। কিছু মানুষ, এদের জীবন আর টুকরো টুকরো কিছু ঘটনার মিশেলে কাহিনী পেয়েছে ভিন্নধারার স্বাদ। পুরানো ঢাকার সহজ-সরল একজন নাটক পাগল মানুষকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে আরো কিছু চরিত্র। হাস্যরস শুরু থেকেই মূল ভূমিকায় ছিলো, কিন্তু কাহিনীর নিয়ন্ত্রণ শেষপর্যন্ত নিয়েছে মানুষের জীবনের গল্প। উল্লেখ্য, যে বিষয়টি আমার কাছে বেখাপ্পা লেগেছে তা হলো ক্লাইম্যাক্স, যেটি একটি সিনেমার অন্যতম মূল চমক। অনলাইনে রিভিউ ঘাটাঘাটির সুবাদে জেনেছিলাম এই সিনেমার শেষে একটি দূর্দান্ত টুইস্ট আছে যা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে বিরল। আজ নিজে দেখে বিষয়টা পরিষ্কার হলাম। যতটা গর্জে ততটা কিন্তু বর্ষেনি। টুইস্ট আছে, কিন্তু সেটা অনেকটাই আরোপিত মনে হয়েছে। পাশাপাশি প্রথাগত বাংলা সিনেমার "নায়ক-নায়িকার মিল হবে, ভিলেন শায়েস্তা হবে" মনোভাব পোষণ করা সংখ্যাগুরু দর্শকদের চাহিদা পূরণের জন্য যেভাবে কাহিনী শেষ করা হলো সেটাও কিঞ্চিৎ হতাশ করেছে আমাকে। ফলে কাহিনীর গতিপ্রকৃতি অনুযায়ী যেটা হতে পারতো ট্র্যাজিক সমাপ্তি, সেটি হয়ে গেলো "অতঃপর উহারা সুখে-শান্তিতে ঘর করিতে লাগিলো", এমন ক্লাইম্যাক্স সিংহভাগ দর্শককে স্বস্তি দিলেও ব্যক্তিগতভাবে আমার মন ভরাতে পারেনি। মনে হয়েছে কাহিনী যেন জোর করে মোড় নেওয়ানো হয়েছে এইদিকে। এটা কাম্য ছিলোনা। এটুকু অংশ বাদ দিলে সিনেমাটি সর্বাঙ্গীনভাবেই প্রশংসার দাবিদার। অমিতাভ রেজা ও তার টিমের সুন্দর প্রয়াস দর্শকদের ধন্যবাদে সিক্ত হচ্ছে কেন তা বোঝা যায় সিনেমাটা দেখলে। বাংলা চলচ্চিত্রের গতানুগতিক মারামারি আর নাচগানে ভরপুর সিনেমা থেকে ভিন্নধারার কোন সিনেমা বানালে (অনেকের কাছে মনে হতে পারে বড় দৈর্ঘ্যের নাটক) তা যে মানুষ সাদরে গ্রহন করবে তা এই সিনেমাটি দেখিয়েছে। আজ সিনেমা হলে গিয়ে বাচ্চা-কাচ্চা সহ পরিবারের আগমণ দেখে আশাবাদী হয়েছি। মানুষ বাংলা সিনেমা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি, ভালো কাহিনীর সিনেমা হলে সবাই সিনেমা হলে আসবেই। পরিশেষে বলতে চাই, যারা এখনো সিনেমাটি দেখেননি তারা হলে গিয়ে সবান্ধব বা আমার মত একা (যদি দূর্ভাগা হন) গিয়ে দেখে আসুন। ঠকবেন না, পুরোপুরি হলিউডি সিনেমার স্বাদ দিতে না পারলেও সমসাময়িক অনেক বাংলা সিনেমার চেয়ে বহুগুণে উন্নত সিনেমার স্বাদ পাবেন। অমিতাভ রেজা কিন্তু এক্সপেক্টেশন বাড়িয়ে দিলো, আগামীতে তার কাছ থেকে এরচেয়েও ভালো কাহিনীর (এবং ত্রুটিমুক্ত, পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই) সিনেমা আশা করতেই পারি।
আইএমডিবি রেটিংঃ 9.8/10
ব্যক্তিগত রেটিংঃ 7/10